Pushpaketur Pancha Rahashya

Language: Bengali

ছায়াময়

শেষ ভাদ্রের প্রভাতকাল শীতলতার আভাসে বড় মনোরম; ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুর সিক্ত ঘ্রাণ, বাগানের এককোনে পারিজাত পুষ্পের বৃক্ষ ও তার বেদীমূল ছেয়ে থাকা ফুলের আস্তরণ কেমন যেন মায়া জাগায়; আসন্ন নবান্ন উৎসবের প্রাক্কালে এযেন প্রকৃতিদেবীর বিশেষ সজ্জা। দিবাভাগের প্রথম প্রহর, চারপাশের প্রকৃতি এখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন, যদিও বর্ধিষ্ণু গৃহটির গোশাল ইতিমধ্যেই কর্মচঞ্চল; গৃহসেবক ভূজঙ্গ সেখানে দুগ্ধ দোহনে ব্যস্ত। গৃহের পিছনভাগের যে অঙ্গন, তার এককোণে তুলসীমণ্ডপ, আর তার পাশে পাকশাল ও জলের কূপ; গৃহসংলগ্ন অলিন্দের একপাশে স্নান ও শৌচাগার। অঙ্গনের শেষে গৃহের পিছনভাগের সরু চলার পথ, সেখানে একটি বাঁশের দরজা মূলতঃ শৌচকর্মীদের যাতায়াতের জন্য নির্মিত। দ্বারের থেকে কিছুটা দূরত্বে অঙ্গনের দুইপাশে দুটি মাটির কুটির; ডানপাশের কুটিরটির পাশে গোশালা ও অশ্ব রাখার ছাউনি, এই কুটিরটি ভূজঙ্গের বাসস্থল। দ্বারের বামপাশের কুটিরটিতে থাকে চঞ্চলা, সে গৃহের একাধারে রাঁধুনি ও দাসী।

চঞ্চলা সুশ্রী ও বয়সে নবীনা, এই প্রভাতকালেও তার সাজ পোশাকে বিশেষ যত্নের ছাপ স্পষ্ট; সে নিজের কক্ষ থেকে দ্রুত মূল গৃহের দিকে যেতে যেতে, একবার কক্ষদ্বারের পানে চেয়ে দেখে, বিগত রজনীর কোনও মধুর স্মৃতিতে রক্তিমাভা দেখা দেয় তার দুই গালে। কবিরা বসন্তকে বলে থাকেন মধুমাস; কিন্তু ভাদরের নীরব আকিঞ্চন, সুন্দরী যুবতীর কাছে সেও কিছু কম মধুর নয়।

পাটলীপুত্রের এক সম্পন্ন পল্লীর নিভৃত পরিবেশে অবস্থিত গৃহটি শ্রেষ্ঠী বসুদত্তের, ফলের বাগান ঘেরা এই বসতবাটি অন্যান্য গৃহের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। মূলভবনটি কাঠের এবং দুইতলবিশিষ্ট; নীচের তলে সমুখের প্রবেশদ্বারের সংলগ্ন একটি বহির্কক্ষ এবং তার পাশে একটি বিশ্রামকক্ষ ও অতিথিশালা। এই তিনটি কক্ষই পিছনের অলিন্দের সাথে যুক্ত। দ্বিতলে দুটি শয়নকক্ষ যার একটিকে গৃহিনী নিজস্ব বিশ্রাম কক্ষ হিসাবে ব্যবহার করেন, সাথে একটি পূজাকক্ষ, সেখানে শ্রী জনার্দন নিত্যপূজা পান; দ্বিতলের সিঁড়ি অলিন্দ সংলগ্ন। গৃহটি আয়তনে বৃহৎ নাহলেও নিঃসন্তান দম্পতির একাকী সংসারের পক্ষে যথেষ্ট। বসুদত্ত মসলা ও গন্ধদ্রব্যের কারবারি, সুদূর প্রাচ্য থেকে সংগৃহিত উত্তম এলা, লবঙ্গ, দারুচিনি, গন্ধমরিচ, তার সাথে অগুরু, ও ধুনক ভৃগুকচ্ছ হয়ে সরবরাহ করেন সুদুর রোমক সাম্রাজ্যে। জলপথ যাত্রা ও বিদেশ ভ্রমণ তাঁর ব্যবসায়ের অঙ্গ; একাজে দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি ঘটে নগরী থেকে, কখনও তিনমাসকাল, কখনও বা তারও বেশী। বসুদত্ত মধ্যবয়স্ক বিষয়ী মানুষ, তবে তাঁর স্ত্রী শ্রীজয়া যুবতী ও সুন্দরী; এটি শ্রেষ্ঠীর দ্বিতীয়পক্ষ। প্রথম স্ত্রী গত হয়েছিলেন যৌবনকালেই, আর তার কিছুদিন পরে মৃত্যু হয় তাঁর পিতারও। সেই থেকে নিজেকে ব্যবসায়ে সঁপে দিয়ে মানুষ করেছিলেন দুটি ভগ্নী ও এক কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে। ভগিনীদের বিবাহ, ভ্রাতা সুদত্তকে ব্যবসায়ে সামিল করা এসবই করেছিলেন তিনি একে একে, এর মাঝে আর বিবাহের চিন্তা মাথায় আসেনি। বিবাহ না করলেও, শোনা যায় একটি উপপত্নী ছিল তাঁর গণিকা পল্লীতে, তবে সেসব বেশ কিছুকাল আগের কথা। সুদত্ত স্বাবলম্বী হতে, তার বিবাহ হয় নগরীর এক সম্ভ্রান্ত গৃহে; স্বামীর বিদেশযাত্রায় সুদত্তর স্ত্রী উপলার আপত্তি দেখা দেয়, ফলে ভ্রাতার থেকে পৃথক হয়ে নগরীতে নিজস্ব গন্ধদ্রব্যের বিপনি প্রতিষ্ঠা করেন সুদত্ত। ততদিনে, মাতারও মৃত্যু ঘটেছে। তিন বৎসর পূর্বে বসুদত্ত প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে, পুনরায় বিবাহ করেন; শোনা যায় মদন মহোৎসবে গঙ্গাতীরে উপাসনারতা শ্রীজয়াকে দেখে তিনি মুগ্ধ হন। শ্রীজয়া অনাথা বিধবার একমাত্র সন্তান, অর্থকৌলিন্যের অভাব পুরন করেছিল তার আলো করা রূপ। কিন্তু এ বিবাহে, পরিবার, বিশেষতঃ সুদত্তের শ্বশুরকুল বিশেষ অসন্তুষ্ট ছিলেন। উপলার বিরূপমনভাব লক্ষ্য করে, কিছুদিনের মধ্যে পৈতৃক গৃহের পাশের বাগানসহ জমিতে নিজস্ব গৃহ তৈরী করে পৃথক হন বসুদত্ত। এর ফলে, সম্পর্কের তিক্ততা দূর হয়ে শান্তি ফেরে, শ্রীজয়াও নিজস্ব সংসার পেয়ে সুখী হয়।

গৃহস্বামী বিগত তিনমাসকাল যাবৎ ব্যবসায় কার্যে গৃহের বাহিরে আছেন, গতকাল দুপুরে সংবাদ এসেছে, তাঁর দুখানি পণ্যতরণী বন্দরে ফিরেছে, সাথে শ্রেষ্ঠীও আছেন। বন্দরের কাজ মিটিয়ে আজ কালের মধ্যেই গৃহে ফিরবেন তিনি। আজকের দিনে সেকারণে চঞ্চলা অতিপ্রত্যুষেই কর্ত্রীকে জাগিয়ে তাঁর স্নানের ব্যবস্থা করতে মূলগৃহে চলেছে; শ্রেষ্ঠীর আবির্ভাবের আশায় বিশেষ ব্যঞ্জনের আয়োজন হবে অবশ্যই, সেবিষয়েও কর্ত্রীর নির্দেশ নেওয়া প্রয়োজন। চঞ্চলা দ্রুত পায়ে অলিন্দ পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের শয়নকক্ষে পা বাড়ায়। দ্বিতলেও নীচতলের  মতই কক্ষ সংলগ্ন একটি অলিন্দ আছে, শয়নকক্ষের দ্বার আবছা ভেজানো দেখে চঞ্চলা অপ্রস্তুত বোধ করে; স্বামিনী তার আসার পূর্বেই উঠে পড়েছেন নিশ্চয়। দীর্ঘ বিরহের অন্তে তরুণী স্ত্রীর উৎকন্ঠা মনে মনে অনুভব করে সে তার নারী হৃদয়ে।

দরজায় মৃদু করাঘাত করে নিজের উপস্থিতি জানান দেয় চঞ্চলা, কক্ষ থেকে আওয়াজ আসে না কোনও, কয়েক মূহুর্ত অপেক্ষা করে ভিতরে প্রবেশ করে সে।

দেওয়ালের পাশ ঘেঁষে রাখা সুদৃশ্য পালঙ্কটি শূন্য; কক্ষের অন্য পাশে খোলা মেঝেতে পড়ে আছে শ্রীজয়ার রক্তাক্ত দেহ, বিস্রস্ত তার কেশ বেশ, কিছু দূরে উল্টে পড়ে আছে একটি চন্দনকাষ্ঠের কারুকার্যমণ্ডিত পীঠক, ও আরো কয়েকটি ছোটখাটো আসবাব। এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে হাহাকার করে ওঠে চঞ্চলা বুদ্ধিভ্রষ্টের মত, তার আর্ত চিৎকারে সচকিত হয় নিস্তব্ধ পরিবেশ। সম্বিৎ ফিরে পেতে অলিন্দে বেরিয়ে ভূজঙ্গের নাম ধরে ডাকতে থাকে সে বারম্বার। ভূজঙ্গ দৌড়ে আসে দুর্ঘটনাস্থলে, কর্ত্রীর দেহের সমুখে গিয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করে তিনি জীবিত কিনা; আপাত নিথর দেহতে প্রাণের স্পর্শ লক্ষিত হয়না। চঞ্চলাকে নাড়িস্পন্দন অনুভব করতে অনুরোধ করে ভূজঙ্গ, একটু ইতস্তত করে এগিয়ে যায় চঞ্চলা, শ্রীজয়া একখানি হাত নিজ হাতে নিয়ে ছিটকে পিছিয়ে যায় সে। কর্ত্রীর দেহ বরফের মত শীতল, তাঁর মৃত্যু ঘটেছে বেশকিছু সময় পূর্বেই।

‘আমি প্রভু সুদত্তকে ডেকে আনছি, তুমি কক্ষত্যাগ কোরনা চঞ্চলা’, ভূজঙ্গ পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়।

চঞ্চলা অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নেয় তার নির্দেশ, অপঘাত হলেও গৃহস্বামিনীর মৃতদেহ পরিত্যাগ করে যাওয়া চলেনা এই অবস্থায়।

অল্পক্ষণের মধ্যেই সুদত্ত ছুটে আসেন ভূজঙ্গের সাথে, ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব দেখায় তাঁকেও। ভাতৃবধূর এই করুণ পরিণতি কল্পনারও অতীত, অসীম মমতায় তার নিথর দেহটিকে ছুঁয়ে দেখেন সুদত্ত, বুঝিবা সামান্য প্রাণস্পন্দনের আশায়; দুচোখ বেয়ে নেমে আসা নীরব অশ্রু গোপন করতে চেষ্টা করেননা তিনি। এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুকাল, ক্রমে নিজেকে সামলে নেন সুদত্ত, একখানি বস্ত্র দিয়ে শবটি ঢেকে দেন তিনি পরম যত্নে; অস্বাভাবিক মৃত্যু, গৃহস্বামী অনুপস্থিত, এক্ষেত্রে তাঁকেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূজঙ্গকে পাটলীপুত্রের মহাদন্ডনায়কের কার্যালয়ে পাঠান তিনি, চঞ্চলার চিৎকারে ইতিমধ্যেই দুএকটি পথচারী এসে ভীড় করেছে, সুদত্তের গৃহের দাস দাসীও উপস্থিত হয় সেইসঙ্গে।

এত প্রত্যুষে কার্যালয় তখনও সচল হয়নি, কয়েকজন প্রহরী ভিন্ন কেউ নেই সেখানে, তবু ভূজঙ্গের বক্তব্য শুনে তাদেরই একজন আধিকারিক ধর্মদাসকে সংবাদ দেয়। একে হত্যা, তায় সম্পন্ন ঘরের গৃহবধূ, ধর্মদাস কয়েকজন প্রহরীসহ তৎক্ষনাৎ রওয়ানা দেন ঘটনার তদন্তে।

‘কক্ষের দ্বার খোলা ছিল যখন মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়?’ ধর্মদাস ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণের পশ্চাতে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন সুদত্তকে।

‘চঞ্চলা যখন দ্বিতলে আসে, কক্ষের দ্বার আবছা ভেজানো ছিল’।

‘আর গৃহের মূল দরজা, সেও কি খোলা ছিল সেসময়ে?’

এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। চঞ্চলা জানায়, অঙ্গন থেকে দ্বিতলে আসতে সমুখ দ্বারের প্রয়োজন হয়না, ফলে সে এ ব্যাপারে কিছু জানেনা। এরপর ভূজঙ্গকে জিজ্ঞাসা করা হলে তাকে বিভ্রান্ত দেখায়, সে বিলক্ষণ সমুখের দরজা দিয়েই সদত্তকে ডাকতে গিয়েছিল, কিন্তু গোলমালে মনে করতে পারেনা সেটি উন্মুক্ত ছিল, না সে নিজে হাতে অর্গল মুক্ত করেছে।

‘গৃহিনী কি শয়নকালে আভরণ খুলে রাখতেন, তাঁর দেহে কোনও গহনা দেখছি না?’ ধর্মদাসের এ প্রশ্নটি চঞ্চলার উদ্দেশ্যে।          

চঞ্চলা জানায়, গৃহিনী গহনায় বিশেষ আসক্ত ছিলেন, কখনওই নিরাভরণ থাকতেন না।

‘মনে হচ্ছে তস্করের কাজ, গহনার লোভেই এ হত্যা, মৃতার স্বামীকে সংবাদ পাঠানোর ব্যবস্থা করুন, আমি আধিকারিক চিত্রককে সংবাদ পাঠাচ্ছি, তিনি এসে শব পরীক্ষা করবেন’, ধর্মদাস জানান সুদত্তকে।

‘শব পরীক্ষা, সৎকার হবে না?’ হাহাকার করে ওঠেন সুদত্ত।

‘যত শীঘ্র সম্ভব পরীক্ষাকার্য সম্পন্ন করা হবে, নিশ্চিন্ত থাকুন ভদ্র। ততক্ষণে মৃতার স্বামীকে আনার ব্যবস্থা করুন; দাহকার্যে কোনও বাধাসৃষ্টি হবেনা।‘ ধর্মদাস বিষবিজ্ঞান ও শরীরবিদ্যা বিশেষজ্ঞ প্রবীণ আধিকারিক চিত্রককে সংবাদ পাঠান প্রহরীর মাধ্যমে।