Atha Ramyakatha

Language: Bengali

লহ প্রণাম

কয়েক বছর আগের কথা, তখন থাকি ভারতবর্ষের একপ্রান্তে একটি আধা ঘুমন্ত শহরে, তবে স্বভূমী বিরহ থাকলেও স্বজনের অভাব নেই সেখানে। বেশ কিছু বাঙ্গালী আছেন শহরটিতে, অন্তত যতজন থাকলে দূর্গাপূজো করা চলে ততজন তো বটেই। তবে বাঙ্গালীরা তো শুধু দূর্গাপূজো আর কূটকাচালিতে থেমে থাকতে পারেনা, তার সাথে চাই সংস্কৃতি; অতএব লাগাও পূজোর চারদিন ধরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আবার শুধু এতেও শান্তি নেই, পূজোর রিহার্সালে আধা বছর পার করা যায়, বাকিটার জন্যেও তো কিছু একটা চাই। তাই সেবছর থেকে শুরু হোল রবীন্দ্রজয়ন্তী।

তখন মার্চ মাসের শেষ, একদিন কালচারাল সেক্রেটারি মশাই আমাকে ফোন করে বললেন যে তিনি এবারের রবীন্দ্র অনুষ্ঠানের স্ক্রীপ্ট লেখার সুযোগ দিতে চান আমাকে। শুনে বেশ অবাক হোলাম, কারণ আমি ক্লাবের নেহাতই এলেবেলে মেম্বার, তায় লিখতে পারি এমন কথা বলিনি কখনও। যাইহোক, সেক্রেটারী বাবু পরেরদিন বাড়িতে এলেন এবং মুরুব্বী কায়দায় বোঝাতে বসলেন আমাকে কি লিখতে হবে। তাঁর কথায় মনে হোল স্ক্রীপ্ট নয়, আমাকে রবীন্দ্রনাথের জীবনী রচনা করতে হবে; তাতেই নিস্তার নেই, সেই জীবনীতে আমাদের হিপি ছাঁট চুল ৯০ র দশকের বলিউডি মনোভাবাপন্ন সেক্রেটারী বনলতা সেন ঢোকাতে চান। এহেন বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে, কি করি একটা বুদ্ধি মাথায় এলো; বললাম এসব তো খুবই সাধারণ, সকলেই এভাবে করে, আপনি একটু অন্যরকম করুন। তিনি আগ্রহ দেখালেন, বললাম পূজারিনী কবিতাটা নাটকের মত করে অভিনয় করান।

‘তাহলে স্ক্রীপ্ট লিখে দাও’।

‘সেকি এতে আবার স্ক্রীপ্ট কি, রবীন্দ্রনাথই তো যা লেখার লিখে গিয়েছেন!’ আমি আঁতকে উঠি।

‘আরে ওই কবিতা লোকে বুঝবে না, তুমি সুন্দর করে লিখে দাও বরং’, সেক্রেটারী অনায়াসে ব্যক্ত করেন।

কবিতা না বুঝলে, রবীন্দ্রজয়ন্তীর দরকার কি? কথাটা মুখে এলেও গিলে নিই; কবিতার সাথে সাথে কথ্য ভাষায় গল্পটা জুড়ে দিই অগত্যা জনগনের স্বার্থে। এরপর তিনি আমায় অনুরোধ করলেন গান পছন্দ করে দিতে, আমি গানের তেমন কিছু বুঝিনা, তাও গল্পের সাথে তাল মিলিয়ে কয়েকটা পূজা পর্যায়ের গান পছন্দ করে দিলাম।

‘এ তো সব প্যানপ্যানানি!’, বলে সেগুলো নাকচ করলেন সেক্রেটারী।

বাধ্য হয়ে রণে ভঙ্গ দিলাম আমি, বললাম ‘আপনার যা ঠিক মনে হয় তাই রাখুন, তবে দয়া করে রবীন্দ্রসঙ্গীতই রাখবেন, কুমার শানু টানু ঢোকাবেন না।‘ এরপর আর কিছু জানিনা, একেবারে সেই অনুষ্ঠানের দিন সৌভাগ্য হোল পূজারিনী দেখবার।

নাটক শুরু হোল, প্রথমেই প্রোজেক্টরের স্ক্রীনে ফুটে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ, বেজে উঠলো মিউজিক। লোকমুখে শুনেছিলাম, সেক্রেটারী মশাই যৌবনকালে মুম্বাই পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন ফিল্ম ডিরেক্টর হবেন বলে, কিন্তু কষাই বাপের শাসানিতে পেরে ওঠেননি; সে শখ তিনি মিটিয়ে নেন ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। তাই এই বার ফিল্মি কায়দায় স্ক্রীনে ভেসে উঠল কলা কুশলীদের নাম ঠিক সিনেমার মতই। তারপর শুরু হোল নাটক, একজন ভাষ্যপাঠ শুরু করলেন, কিন্তু বিকট ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জেরে কিছুই প্রায় কানে পৌঁছল না আমাদের। এবার পাঠের মাঝখানে গান, আর তার সাথে দাসী শ্রীমতীর নাচ। গানটি একটি পরিচিত তালের গান, কিন্তু বিচিত্র মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টের দাপটে সেটি চিনে উঠতে বেশ সময় লাগল; গান শুরু হতে বিয়ের কনের সাজ সেজে স্টেজে ঢুকলো শ্রীমতী, সাথে চকমকে ঘাগরা পরা কয়েকজন সহচরী (ফিল্মের ব্যাকগ্রাউন্ড ডান্সার গোছের)। তাদের অঙ্গ দুলিয়ে দুর্বার নৃত্য দেখতে দেখতে মাথাটা কেমন ঘেঁটে গেলো, এদিকে পাশে বসা এক দাদা মন্তব্য করলেন, ‘স্ক্রীনে যে শার্ট প্যান্ট!’  তাকিয়ে দেখি, পেছনের স্ক্রীনে আধুনিক পোশাকে একটি লোক দুহাত তুলে আকাশের পানে চেয়ে আছে, তখন গান চলছে ‘এই আকাশে আমার মুক্তি…’। অবশেষে, শেষ দৃশ্য, রাজার সেনা রে রে করে রঘু ডাকাত স্টাইলে তেড়ে আসছে শ্রীমতীর দিকে, ঘাড়ে কোপ পড়ল বলে; আর সেই আনন্দে শ্রীমতী গেয়ে উঠল ‘মন মোর মেঘের সঙ্গীতে…’ সাথে দুলে দুলে নাগিন ড্যান্স অনেকটা শ্রীদেবী স্টাইলে, শুনেছিলাম সেক্রেটারী পত্নী নাকি কোরিওগ্রাফি করেছেন ইউটিউব দেখে। এরপর, কৃপানের ঘা খেয়ে শ্রীমতী মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, আর ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ভেসে এলো ‘আআআআ!’ সাউন্ড এফেক্ট, অনেকটা রামসে ব্রাদার্সের হরর মুভি স্টাইলে।

নাটক শেষ হতে কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা, আর তারপরেই ফেটে পড়ল হল; না হাততালিতে নয়, অডিয়েন্সের অট্টহাসিতে। সেবার পূজোর অনুষ্ঠানের আগেই সেক্রেটারী দাদা রিজাইন দিয়েছিলেন পদ থেকে, বেরসিক দর্শকদের বিটলেমিতেই বোধকরি।

***